কক্সবংলা ডটকম :: জ্যৈষ্ঠের চাপা গরমে আম যখন আমজনতার হয়ে যায়, তখন নাকি মধ্যগগনে থাকে মধু মাস। তা এখন গাছে পাকা কাঁঠালের গন্ধ। লিচু গিয়ে জাম এসেছে ঝুড়িতে। মৌসুমি ফলের মতো খেলাধুলাতেও আসছে মধু মাস। টি২০ বিশ্বকাপ, ইউরো ফুটবল আর কোপা আমেরিকা– বশ করার জন্য রসে সাজানো এ তিনটি সুমিষ্ট ফলই কি যথেষ্ট নয়! ক্রীড়াপ্রেমীর জন্য এ যেন ‘মধু-গন্ধে-ভরা মৃদু-স্নিগ্ধছায়া নীপ-কুঞ্জতলে’।
সেখানে শুরুতে টি২০ বিশ্বকাপ লিচু হলেও টনি ক্রুজ-এমবাপ্পেদের ইউরো ফুটবলকে আম্রপালি বলা যেতেই পারে। আর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা? এ রায় দেওয়ার সাধ্যি নেই। যে যার মতো পছন্দের সেরা নামটি এখানে দিয়ে নিতে পারেন।
আপাতত মেঘমুক্ত সহাস্য শশাঙ্ককলায় শুরুটা হোক ক্রিকেটের ধুমধাড়াক্কা চার-ছক্কা দিয়েই। টি২০ বিশ্বকাপের অতীত ধারা বদলে এবার বিশ্বায়নের প্রতি বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য খেলার সঙ্গে তুলনা করলে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ সেই অর্থে আটকে ১০ থেকে ১২টি দেশের মধ্যেই। যে কারণে অলিম্পিক গেমসের মতো ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসরে এই খেলা অনুপস্থিত থাকে। এই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কিন্তু অন্য অনেক খেলাকে টেক্কা দেবে। দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা আর ক্যারিবীয় অঞ্চল মিলিয়ে ক্রিকেট অনুসরণ করা লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
সেটি মাথায় রেখেই এবারের টি২০ বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০ করা হয়েছে। ম্যাচের সংখ্যাও এখন পর্যন্ত যে কোনো বিশ্বকাপের চেয়ে বেশি– ৫৫টি। উগান্ডা, পাপুয়া নিউগিনি, কানাডা, নেপাল, ওমানের মতো নবাগতের আগমন ঘটেছে এবার। নতুনত্ব আছে বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েও। জর্জ ওয়াশিংটনের দেশের মানুষ ব্যাট-বল নিয়ে খেলা বলতে বেসবলের সঙ্গেই বেশি পরিচিত। খেলাধুলা নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তাদের উন্মাদনা তুঙ্গে থাকে বাস্কেটবলে। এমনকি ফুটবলের বিশ্বনন্দিত তারকা লিওনেল মেসিকেও সেখানে চেনাতে সময় লেগেছে। বাস্কেটবলের লেবরন জেমস-স্টিফেন কুরির দেশে কোহলি-সাকিবরা কি পারবেন মার্কিনিদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টেনে আনতে?
নিউইয়র্ক, ডালাস, শিকাগোর পরিচিত কিছু বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে যে পূর্বাভাস মিলেছে, তাতে ক্রিকেটের মধুরেণু নিয়ে স্থানীয় আমেরিকানদের মধ্যে কোনো কৌতূহলই নেই। সেখানে সেই দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের কারণে যা একটু আলোচনা এই বিশ্বকাপ ঘিরে। আইসিসির একটি প্রচারণামূলক ভিডিওতে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখানো হয়েছে, ক্রিকেট যেন ভিন্নগ্রহ দেখে আসা একটি খেলা, যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে এবারের বিশ্ব আসরে।
আসলে বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের পরিচিতিটা ডালাস আর নিউইয়র্ক দিয়েই করানো হবে। নিউইয়র্কে একটি পার্কের মাঝে খালি জায়গা দু’মাস ধরে পরিষ্কার করে গ্যালারিসহ ক্রিকেটের অস্থায়ী স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে (তাও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ এই মাঠে হবে বলে)। আর ডালাসে বেসবলের একটি মাঠ ভাড়া করা হয়েছে কিছুদিনের জন্য।
এবার আসা যাক সাকিব-শান্তদের কথায়। এবার কেমন করবে বাংলাদেশ? প্রশ্নের উত্তর দিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার বোধ হয় দরকার পড়ে না। গত আট আসরে বাংলাদেশ কী করতে পেরেছে? আর শান্তদের সাম্প্রতিক এই ফরম্যাটে পারফরম্যান্স কী? জানা থাকলে আসরে জিপিএ ৫ পাওয়ার মতো কেউ আশা করবে না। এখানে একটা তথ্য যোগ করা যায়। তা হলো ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সবক’টি টি২০ বিশ্বকাপে মোট ৯টি দেশ অংশ নিয়েছে। যার মধ্যে প্রতিটি দেশই কোনো না কোনো আসরে সেমিফাইনালে উঠেছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।
ক্রিকেটের এই ইলেকটিভ ম্যাথে একেবারেই কাঁচা ঘরের ছেলেরা। তার পরও নিজ গাছের ফল বলে কথা। টক-মিষ্টি যাই হোক, একটা গর্বের ব্যাপার তো থাকেই। আর হিসাবটাও বেশ সহজ। গ্রুপ পর্ব থেকে সুপার এইটে যেতে হলে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ দুটিকেই পাখির চোখ ভাবতে হবে। অবশ্য তার আগে এই বিশ্বাসে দৃঢ় থাকতে হবে, নেপাল ও নেদারল্যান্ডসকে সহজেই হারানো সম্ভব। দলের ভেতরে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে শুরুর শ্রীলঙ্কা ম্যাচটিতেই প্রলয় ঝড় তুলতে হবে।
ওই ম্যাচটি হাতে এসে গেলে সেই আত্মবিশ্বাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও কিছু একটা হয়ে যেতে পারে, যেটা অতীতে বিশ্ব আসরে হয়েছে। তবে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত কিন্তু এ আসর ঘিরে সমর্থকদের বারবার শান্তই থাকতে বলেছেন। ‘অবশ্যই বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্য থাকবে আমাদের’– এ জাতীয় কোনো বক্তব্য রিপোর্টারের জোরাজুরিতে দেননি অধিনায়ক। আসলে তিনি বা তাঁর দল চাইছে না, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তাদের এই মার্কিন ও ক্যারিবীয় যাত্রা নিয়ে ফেসবুকের দেয়ালে প্রত্যাশার বিস্ফোরণ ঘটুক। কিংবা অলীক কোনো গল্প বানিয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা বাড়াবাড়ি করুক।
আইপিএলের ঘোর কাটিয়ে ক্রিকেট-দর্শকও যেন কিছুটা ক্লান্ত-স্তব্ধ। একটু দম নিয়ে নতুন করে রুটিন সাজাতে হবে তাদের। খেলাধুলার ঋতুরঙ্গে ২ জুন শুরু টি২০ বিশ্বকাপ। সেখানে ম্যাচগুলোর বেশির ভাগই সকাল সাড়ে ৬টায়। কিছু ম্যাচ রয়েছে রাত সাড়ে ৮টায়, আর কিছু সকাল সাড়ে ৫টায়। গ্রুপ পর্বে যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে বাংলাদেশের ম্যাচ রয়েছে ১৭ জুন পর্যন্ত। শান্ত-সাকিবদের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে টি২০ বিশ্বকাপে সমর্থকদের গা ঘেঁষাঘেঁষির একাত্মতা।
যদি সেখানে পারদ না চড়ে, তাহলে ১৪ জুন থেকে শুরু হওয়া ইউরো ফুটবল বাজার ধরে নেবে খেলাধুলার এই মধু মাসে। সেখানেও ম্যাচের সময় মগজাস্থ করতে হবে দর্শককে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু করে রাত ১০টা এবং রাত ১টায় শুরু হবে জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের সব ম্যাচ। সারাবছর রাত জেগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল দেখা চোখগুলোর কাছে এ এক অমোঘ আকর্ষণ। জার্মানির ১০টি শহরে ২৪ দল নিয়ে শুরু হবে ইউরোপের সেরা ফুটবল দল নির্বাচনে। এক মাসের এই ফুটবল মাধুরী বরাবরই উন্মাদিত করেছে বাংলাদেশকে।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও বলে, বিশ্বকাপের চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তাদের এই ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ। দাবি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। ইতালির কথাই ধরা যাক, ইউরোর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন তারা। অথচ গেল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি শুধু ইউরোপিয়ান কোটার কারণে। অথচ লাতিন বা আফ্রিকার অনেক নিচু র্যাঙ্কিংয়ের দল কিনা বিশ্বকাপ খেলেছে। গতি আর শৈলীতে ইউরোপের প্রতিটি দলই কাছাকাছি। সেখানে এমবাপ্পে, হ্যারি কেইন, টনি ক্রুজ, লুকা মডরিচ, লেভানডস্কিদের খেলা দেখা যাবে এক মাসের মধু পার্বণে। সেখানে শুধু মিসিং থাকবেন নরওয়ের আর্লিং হালান্ড।
যেমন সবাই মিস করবে ব্রাজিলের নেইমারকে। ইউরো শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর ২১ জুন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হবে লাতিনের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। কোপা আমেরিকার ম্যাচগুলো আবার সকালে– ৬টা ও ৭টা। ঘুম থেকে চোখ কচলিয়ে উঠেই দেখা যাবে মেসির আর্জেন্টিনা কিংবা ভিনিসিয়ুসের ব্রাজিলের খেলা।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার হয়ে এটাই যে মেসির শেষ কোপা আমেরিকা, সেটা তিনি আগেই বলে রেখেছেন। কোপা নিয়ে হয়তো বাড়ির ছাদে পতাকার মিছিল দেখা যাবে না। তার পরও যে জলসায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থাকবে, সেখানে আউল-বাউল উদাস হাওয়াও থাকবে। মিলেমিশে থাকলেও বিভক্তির ছন্নমতি কুহুকও থাকবে। ক্রিকেটের পাশাপাশি রাতে এমবাপ্পে আর সকালে মেসি– মধু মাসের ঘ্রাণটাই যেন আলাদা।
Posted ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta